অ্যাজমা ব্যাপারটা কি?
অ্যাজমা বা হাঁপানি আসলে শ্বাসনালীর অসুখ। যদি কোন কারণে শ্বাসনালীগুলো অতিমাত্রায় সংবেদনশীল (হাইপারসেনসিটিভ) হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন ধরনের উত্তেজনায় উদ্দীপ্ত হয় তখন বাতাস চলাচলের পথে বাধার সৃষ্টি হয়, ফলে শ্বাস নিতে বা ফেলতে কষ্ট হয়। কেন হয়?
জেনেটিক পরিবেশগত কারণে কারও কারও বেশি হয়ে থাকে। ঘর-বাড়ির ধুলো ময়লায় মাইট জিবাণু, ফুলের বা ঘাসের পরাগ রেণু, পাখির পালক, জীব-জন্তুর পশম, ছত্রাক, কিছু কিছু খাবার, কিছু কিছু ওষুধ, নানারকম রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি থেকে এলার্জিজনিত অ্যাজমা হয়ে থাকে।
কাদের হতে পারে হাঁপানি?
যে কোন বয়সের স্ত্রী, পুরুষ, শিশু-কিশোর যে কারো হতে পারে। যাদের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের হাঁপানি আছে তাদের এ রোগ হবার আশঙ্কা প্রবল। আবার দাদা-দাদীর থাকলে (বাবা-মা’র না থাকলেও) নাতি-নাতনী বা তাদের ছেলেমেয়েরা এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। পিতৃকুলের চেয়ে মাতৃকুল থেকে হাঁপানিতে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা বেশি থাকে।
অ্যাজমাতে কেন এই শ্বাস কষ্ট?
আমাদের শ্বাসনালীগুলো খুবই ক্ষুদ্র। ২ মি.মি. থেকে ৫ মি.মি. ব্যাস বিশিষ্ট। চারদিকে মাংসপেশি পরিবেষ্টিত। এই ক্ষুদ্র শ্বাসনালীর ভেতর দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় খুব সহজেই বাতাস আসা-যাওয়া করতে পারে। যদি কখনো এলার্জিক বা উত্তেজক কোন জিনিস শরীরে প্রবেশ করে তখন শ্বাসনালীর মাংস পেশীগুলো সংকুচিত হয়। ফলে শ্বাসনালী সরু হয়ে যায়। তাছাড়া উত্তেজক জিনিসের প্রভাবে শ্বাসনালীর গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় আঠালো মিউপাস জাতীয় কফ, আর ইনফেকশনের কারণে শ্বাসনালীর ভেতরের দিককার মিউকাস আবরণী আঠাল কফ উঠিয়ে ফেলার লক্ষ্যে অনবরত কাশি হয়ে থাকে। কখনো কখনো এই শ্বাসনালী এত সরু হয় যে, বাতাস বায়ুথলিতে পৌঁছয় না, তখন শরীরে অক্সিজেনের অভাব হয়। এটা খুবই মারাত্মক অবস্থা। এ অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলে অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে। অ্যাজমা কি ছোয়াছে রোগ? না, অ্যাজমা ছোঁয়াচে রোগ নয়। পারিবারিক বা বংশগতভাবে অ্যাজমা হতে পারে। কিন্তু ছোঁয়াচে নয়। অ্যাজমায় আক্রান্ত মায়ের বুকের দুখ খেয়ে শিশুদের অ্যাজমায় আক্রান্ত হবার আশঙ্কা নেই। মায়ের সংস্পর্শ থেকেও হওয়ার আশঙ্কা নেই।
বংশগতভাবে অ্যাজমার ঝুঁকি কতটা? মাতৃকুলে হাঁপানি থাকলে তিনগুণ বেশি রিস্ক আর পিতৃকুলে হাঁপানি থাকলে অনেকটা কম রিস্ক। মায়ের হাঁপানি থাকলে মোটামুটিভাবে বলায় তিন সন্তানের মধ্যে একটির হাঁপানি, একটির আপাত সুস্বাস্থ্য এবং একটির অস্বাভাবিক শ্বাসনালীর সংকোচন থাকতে পারে। শেষেরটির হাঁপানি না হয়ে সর্দি কাশির প্রবণতা থাকতে পারে।
কিভাবে এই রোগ চিহ্নিত করা যায়?
অ্যাজমা রোগের প্রধান উপসর্গ বা লক্ষণগুলো হলো-
* বুকের ভেতর বাঁশির মতো সাঁই সাঁই আওয়াজ * শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট * দম খাটো অর্থাৎ ফুসফুস ভরে দম নিতে না পারা * ঘন ঘন কাশি * বুকে আঁটসাঁট বা দম বন্ধ ভাব * রাতে ঘুম থেকে উঠে বসে থাকা
আপনার হাঁপানি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে বুঝবেন কিভাবে?
উপশমকারী ওষুধের পরিমাণ বাড়তে থাকা এবং ইনহেলার দ্বারা উপশম ৩-৪ ঘণ্টার বেশি যদি না থাকা। বাতে শ্বাসকষ্টে ঘুম ভেঙে যাওয়া স্বাভাবিক কাজকর্মে শ্বাসকষ্ট হওয়া। পিক ফ্লো ধীরে ধীরে কমা। এসব উপসর্গের উপস্থিতি মানে আপনার হাঁপানি আর নিয়ন্ত্রণে নেই। অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে কি বিপদ হতে পারে? মারাত্মক জটিল অ্যাজমা হতে পারে। স্থায়ী পুরনো অ্যাজমায় পরিবর্তন হতে পারে। স্থায়ী পুরনো অ্যাজমা থেকে হার্ট ফেলিউর হয়ে পানি আসতে পারে এবং রোগী শয্যাশায়ী হয়ে যেতে পারে। শরীরে সব সময় অক্সিজেন কম থাকতে পারে। তাই সবসময় অবসাদগ্রস্ত মনে হবে। অক্সিজেনের অভাবে স্মৃতিশক্তি কমতে থাকে এবং অকালে নিজেকে বৃদ্ধদের মতো দুর্বল মনে হবে। ফুসফুসের অংশবিশেষ চুপসে যেতে পারে। নিউমোনয়াও হতে পারে। পায়ে পানি আসতে পারে। মুখ থেকে ছিটেফোঁটে রক্ত বেরিয়ে আসতে পারে। এক্ষেত্রে কাশি বন্ধ করার ওষুধটা দেয়া জরুরি।
মারাত্মকভাবে আক্রান্ত কিনা বুঝবেন কিভাবে? যখন উপশমকারী ইনহেলার ব্যবহার করে ৫-১০ মিনিটের ভেতর শ্বাসকষ্ট লাঘব হচ্ছে না তখন বুঝতে হবে আপনার হাঁপানি মারাত্মক অবস্থা ধারণ করতে যাচ্ছে। রোগীর সঠিক পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ অ্যাজমার উপসর্গ ও তীব্রতা পরিবর্তিত হয়, ফলে চিকিৎসা পরিবর্তেনের দরকার হয়। অ্যাজমার জন্য দায়ী এলারজেনের পরিবর্তন হতে পারে। অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। নতুন সংযোজন, পুনঃপরীক্ষণ এবং তাগিদের দরকার হতে পারে।
* প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা কি?
* রক্ত পরীক্ষা : বিশেষ রক্তে ইয়োসিনোফিলের মাত্রা বেশি আছে কিনা তা দেখা। * সিরাম আইজিই’র মাত্রা: সাধারণত এলার্জি রোগীদের ক্ষেত্রে আইজিই’র মাত্রা বেশি থাকে। * স্কিন প্রিক টেস্ট : এই পরীক্ষায় রোগীর চামড়ার উপর বিভিন্ন এলার্জেন দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং এই পরীক্ষাতে কোন কোন জিনিসে রোগীর এলার্জি আছে তা ধরা পড়ে। * প্যাচ টেস্ট : এই পরীক্ষায় রোগীর ত্বকের উপর করা হয় * বুকের এক্সরে : হাঁপানি রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসা শুরু করার আগে অবশ্যই বুকের এক্সরে-করে নেয়া দরকার যে অন্য কোন কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কি না। * স্পাইরোমেট্রি বা ফুসফুসের ক্ষমতা দেখা: এই পরীক্ষা করে রোগীর ফুসফুসের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা যায়।
অ্যাজমার জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা?
উপশমকারী ওষুধ ৫-১০ মিনিট পর আবার নিতে হবে। নিজেকে শান্ত রাখুন, স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে চেষ্টা করুন। যেভাবে বসলে আরাম লাগে সেভাবে বসুন। আপনার হাত হাঁটুর ওপরে রাখুন, যাতে সোজা হয়ে বসে থাকতে পারেন। শ্বাস তাড়াহুড়া করে নেবেন না, তাড়াহুড়া করে শ্বাস নিলোব সাদগ্রস্ত হয়ে যাবেন। যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তার বা সাহায্যকারীর শরণাপন্ন হোন। সমন্বিতভাবে এলার্জির চিকিৎসা হলো : * এলার্জেন পরিহার : হাঁপানির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে সহজ পন্থা হলো যে জিনিসে এলার্জি তা যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলা। তাই অ্যাজমা রোগীদের প্রথমেই এলার্জি টেস্ট করে জানা দরকার তার কিসে কিসে এলার্জি হয়। * ওষুধ প্রয়োগ : নানা ধরনের হাঁপানির ওষুধ আছে। প্রয়োজন মতো ওষুধ ব্যবহার করে রোগী সুস্থ থাকতে পারেন সাধারণত দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
ক) শ্বাসনালীর সংকোচন প্রসারিত করতে ওষুধ ব্যবহার করা ব্রস্কোডাইলেটর যেমন-সাববিউটামল, থিউফইলিন, ব্যামবুটারন। এ ওষুধগুলো টেবলেট, সিরাপ, ইনজেকশন, ইনহেলার হিসেবে পাওয়া যায়।
খ) প্রদাহ নিরময়ের ওষুধ যেমন-কর্টিকোস্টেরয়েড বেকলোমেথাসন, ট্রাইঅ্যামসিনোলোন, ফ্লোটিকাসন এগুলো ইনহেলার রোটাহেলার, একুহেলার ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং লিউকোট্রাইন নিয়ন্ত্রক- মন্টিলুকাস্ট, জাফিরলুকাস্ট ব্যবহার করা। * এলার্জি ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপি : এলার্জি দ্রব্যাদি এড়িয়ে চলা ও ওষুধের পাশাপাশি ভ্যাকসিনও অ্যাজমা রোগীদের সুস্থ থাকার অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি। এ পদ্ধতি ব্যবহারে কর্টিকোস্টেরয়েডের ব্যবহার অনেক কমে যায়। ফলে কর্টিকোস্টেরয়েডের বহুল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই ভ্যাকসিন পদ্ধতির চিকিৎসাকে এলার্জিজনিত অ্যাজমা রোগের অন্যতম চিকিৎসা বলে অভিহিত করেন। এটাই অ্যাজমা রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি সুস্থ থাকা একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি। আগে ধারণা ছিল অ্যাজমা একবার হলে আর সারে না। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। প্রথম দিকে ধরা পড়লে এলার্জিজনিত অ্যাজমা রোগ একেবারে সারিয়ে তোলা সম্ভব। অবহেলা করলে এবং রোগ অনেক দিন ধরে চলথে থাকলে নিরাময় করা কঠিন হয়ে পড়ে। বর্তমানে এলার্জিজনিত অ্যাজমা রোগের ভ্যাকসিনসহ উন্নত চিকিৎসা আমাদের দেশেই হচ্ছে।
ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস
দি এলার্জি এন্ড অ্যাজমা সেন্টার
৫৭/১৫ পান্থপথ, ঢাকা
ফোন : ৮১২৯৩৮৩
মোবাইল : ০১৭২১৮৬৮৬০৬।
– See more at: http://www.dailyinqilab.com/2015/02/04/237605.php#sthash.B5GI6PS3.dpuf