ডাক্তার/মেডিকেল ছাত্র কথাটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে গায়ে ধবধবে সাদা এপ্রোন জড়ানো, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো কোন মানুষের প্রতিচ্ছবি। কালের বিবর্তনে নানা পেশায় এপ্রোনের ব্যবহার যুক্ত হলেও স্টেথোস্কোপ নামক ছোট্ট যন্ত্রটির উপর এখনও রয়েছে চিকিৎসক/মেডিকেল ছাত্রদের একক আধিপত্য। ইন্সট্রুমেন্ট রিভিউ বিভাগে আজকে আমরা স্টেথোস্কোপ নিয়ে আলোচনা করব।
স্টেথোস্কোপ কীঃ
স্টেথোস্কোপ হলো মানুষ অথবা প্রাণিদেহের হৃদস্পন্দন কিংবা অন্যান্য অভ্যন্তরীন শব্দ শোনার জন্য ব্যবহৃত একটি ডাক্তারী যন্ত্র। এটি প্রধানত হৃদস্পন্দন এবং নি:শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে ব্যবহার করা হয়। তবে এটি অন্ত্র, ধমনী এবং শিরার রক্ত বয়ে চলার শব্দ শোনার জন্যও ব্যবহৃত হয়। এটিকে ডাক্তারী পেশার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
আবিষ্কারের ইতিহাসঃ
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অতি প্রয়োজনীয় এ যন্ত্রটি আবিষ্কৃত হয় খুবই সাধারণ একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। রেঁনে লেনেক (Rene Lanec 1181-1826) নামক একজন ফরাসী চিকিৎসক ১৮১৬ সালে এটি আবিষ্কার করেন। একদিন তার চেম্বারে এক তরুনী আসেন বুকে ব্যাথা নিয়ে। রোগীর সাথে কথা বলে তার মনে হলো যে, রোগীটি হৃদরোগে আক্রান্ত। তখনকার দিনে চিকিৎসকেরা সাধারনত রোগীর বুকে কান পেতে হৃদস্পন্দন শুনতেন। কিন্তু আগত রোগীটি তরুনী হওয়ায় এ পদ্ধতি প্রয়োগে লেনেক ইতস্ততঃ বোধ করছিলেন। তখনই তার মাথায় অত্যন্ত সাধারন কিন্তু যুগান্তকারী একটি আইডিয়ার উদ্ভব হয়। তিনি কয়েকটি পেপার শিট একসাথে মুড়িয়ে একটি নল তৈরী করেন যার একপ্রান্ত রোগীর বুকে লাগান, অপর প্রান্তে নিজ কান পাতেন। তিনি আবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, তার এ পদ্ধতিতে হৃদস্পন্দন পূর্বের তুলনায় জোরালো ও পরিষ্কারভাবে শোনা যাচ্ছে। পরবর্তিতে তিনি কাঠ দিয়ে অনুরূপ একটি নল তৈরী করেন।
বিবর্তনঃ
স্টেথোস্কোপকে একটি সাধারন কাঠের নল থেকে বর্তমান রূপে নিয়ে আসার পেছনে বহু চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে। বৃটিশ চিকিৎসক গোল্ডিং বার্ড (Golding Bird) স্টেথোস্কোপে সর্বপ্রথম নমনীয় রাবার টিউব ব্যবহার করেন। তবে বার্ডের স্টেথোতে একটিমাত্র ইয়ারপিস (Earpiece)) ছিল। পরবর্তিতে George Camman সর্বপ্রথম বানিজ্যিক স্টেথোর ডিজাইন করেন। ১৯৬০ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের শিক্ষক প্রফেসর ড. ডেভিড লিটম্যান এক ধরনের স্টেথোস্কোপ তৈরী করেন যেটি ছিল আগের যন্ত্রগুলোর তুলনায় অধিক হালকা এবং শ্রুতিগুণসম্পন্ন। লিটম্যানের স্টেথো আজও চিকিৎসকদের প্রথম পছন্দ হিসেবে প্রচলিত। তিনিই সর্বপ্রথম টিউনেবল ডায়াফ্রাম ব্যবহার করেন।
মূলনীতিঃ
“বায়ু মাধ্যমের তুলনায় কঠিন মাধ্যমে শব্দের বেগ বেশী”- পদার্থবিজ্ঞানের এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করেই প্রথম স্টেথোস্কোপ আবিষ্কৃত হয়। বর্তমানে অত্যাধুনিক স্টেথোস্কোপগুলোতে পদার্থ বিজ্ঞানের আরও অনেক মৌলিক তত্ত্ব প্রয়োগ করা হচ্ছে।
প্রকারভেদঃ
স্টেথোস্কোপ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. Acuostic Stethoscope: আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা সচরাচর এই ধরনের স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করেন
২. Electronic Stethoscope: এ ধরনের স্টেথোস্কোপ শব্দতরঙ্গকে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত করে সেটিকে অ্যাম্পিফাই করে জোরালো ও পরিষ্কার শব্দে পরিণত করে।
৩. Noise Reduction Stethoscope: এ ধরনের স্টেথোস্কোপ চারপাশের অপ্রয়োজনীয় নয়েজ বাদ দিয়ে কেবল কাংখিত শব্দ শুনতে সাহায্য করে।
৪. Recording Stethoscope: এর সাহায্যে শ্র“ত শব্দকে রেকর্ড করে রাখা যায় এবং পরবর্তীতে ধারনকৃত শব্দ বিশ্লেষন করে রোগ নির্ণয় করা হয়।
৫. Fetal Stethoscope: ভ্রুনের হৃদস্পন্দন শুনতে এ ধরনের স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করা হয়।
স্টেথোস্কোপের নানাবিধ ব্যবহার থাকলেও চিকিৎসকেরা মূলতঃ রোগ নির্ণয়ের কাজেই এটি ব্যবহার করেন। রোগীর Clinical Examination এর চারটি ধাপের মধ্যে একটি হচ্ছে Auscultation, যা স্টেথোস্কোপের সাহায্য ছাড়া প্রায় অসম্ভব। সব মিলিয়ে অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে স্টেথোস্কোপ ছাড়া ডাক্তারী জীবন অকল্পনীয়ই মনে হচ্ছে।
অনুলিখনঃ মাহবুব (ডি.এম.সি)