আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এবং পেনিসিলিন আবিষ্কারের পেছনের কাহিনী

সায়েন্টিস্ট রিভিউঃ

indexবিজ্ঞান মানুষের জীবনযাত্রার মানকে পাল্টে দিয়েছে। সবক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের অবদান উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান কাজ করে মানবকল্যাণের নিমিত্তে। আর ‘পেনিসিলিন’ মানব কল্যাণের একটি অসামান্য আবিষ্কার। এই পেনিসিলিনের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ছিলেন একজন চিকিৎসক ও জীবাণুতত্ত্ববিদ।

আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন আকস্মিক এক ঘটনাক্রমে। স্ট্যাফাইলোকক্কাস নামক জীবাণু নিয়ে কাজ করতে গিয়েই তিনি এমন এক ধরনের ছত্রাকের সন্ধান পান, যার জীবাণুনাশক ক্ষমতা রয়েছে। ছত্রাকটির নাম ‘পেনিসিলিয়াম নোটেটাম’।

আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর জন্ম ১৮৮১ সালের ৬ই আগষ্ট স্কটল্যান্ডের অর্ন্তগত লকফিল্ড নামক এক পাহাড়ী গ্রামে। বাবা ছিলেন চাষী। আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। দারিদ্রের মধ্যেই ছেলেবেলা কাটে ফ্লেমিং এর। যখন তার বয়স ৭ বছর, তখন তিনি বাবাকে হারান। অভাবের জন্য প্রাইমারী স্কুলের গন্ডিটুকুও শেষ করতে পারেন নি। যখন ফ্লেমিং এর বয়স ১৪, তখন তার ভাইয়েরা সকলে এসে বাসা বাঁধলো লন্ডন শহরে। তাদের দেখাশুনার ভার ছিল বোনের উপর। কিছুদিন কাজের সন্ধানে ঘোরাঘুরি করার পর ১৬ বছর বয়সে এক জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি পেলেন ফ্লেমিং, অফিসে ফাইফরমাশ খাটার কাজ।

কিছুদিন চাকরি করেই কেটে গেল। ফ্লেমিং এর এক চাচা ছিলেন নি:সন্তান। হঠাৎ তিনি মারা গেলেন। তার সব সম্পত্তি পেয়ে গেলেন ফ্লেমিং এর ভাইয়েরা। ফ্লেমিং এর বড় ভাই টস এর পরামর্শ মতো ফ্লেমিং জাহাজ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়ে মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হলেন। ১৯০৮ সালে ডাক্তারির শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন। কারণ, সেনাবাহিনীতে খেলাধুলার সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি!

কয়েক বছর সামরিক বাহিনীতে কাজ করার পর ইউরোপ জুড়ে শুরু হল ১ম বিশ্বযুদ্ধ। সে সময় ফ্লেমিং ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীর ডাক্তার হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে যে গবেষণা করছিলেন, এখানেই প্রথম তার পরীক্ষা করার সুযোগ পেলেন। হাসপাতালে প্রতিদিন অসংখ্য সৈনিক এসে ভর্তি হচ্ছিল। তাদের অনেকেরই ক্ষত ব্যাক্টেরিয়ায় দূষিত হয়ে উঠেছিল। ফ্লেমিং লক্ষ করলেন, যে সব অ্যান্টিসেপ্টিক ঔষধ চালু আছে তা কোন ভাবেই কার্যকরী হচ্ছে না। ক্ষত বেড়েই চলেছে। যদি খুব বেশি পরিমাণে অ্যান্টিসেপ্টিক ব্যবহার করা হয়, সে ক্ষেত্রে ব্যাক্টেরিয়া কিছু পরিমাণে ধ্বংস হলেও দেহকোষগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফ্লেমিং উপলব্ধি করলেন, দেহের স্বাভাবিক শক্তিই একমাত্র এসব ব্যাক্টেরিয়াগুলো প্রতিরোধ করতে পারে, কিন্তু তার ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ।

১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হলো, ২ মাস পর ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন ফ্লেমিং। আন্তরিক প্রচেষ্টা স্বত্ত্বেও জীবাণুগুলোকে ধ্বংস করার মত কিছুই খুঁজে পেলেন না। ইংল্যান্ডে ফিরে এসে তিনি সেন্ট মেরিজ মেডিকেল স্কুলে ব্যাক্টেরিয়োলোজির প্রফেসর হিসেবে যোগ দিলেন। এখানে পুরোপুরিভাবে ব্যাক্টেরিয়োলোজি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সঠিকভাবে উপলব্ধি করলেন মানবদেহের কিছু নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে যা এ বহিরাগত জীবাণু প্রতিরোধ করতে পারে। কিন্তু প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ পেলেন না। ১৯২১ সালে, একদিন ল্যাবরেটরিতে বসে কাজ করছিলেন ফ্লেমিং। কয়েকদিন ধরেই তার শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। সর্দি কাশিতে ভুগছিলেন। তিনি তখন প্লেটে জীবাণু কালচার নিয়ে কাজ করছিলেন, হঠাৎ প্রচন্ড হাঁচি এল। নিজেকে সামলাতে পারলেন না ফ্লেমিং। প্লেটটা সরাবার আগেই নাক থেকে খানিকটা সর্দি এসে পড়ল প্লেটের উপর। পুরো জিনিসটি নষ্ট হয়ে গেল দেখে প্লেটটি একপাশে সরিয়ে রেখে নতুন একটা প্লেট নিয়ে কাজ শুরু করলেন। কাজ শেষ হয়ে গেলে বাড়ি ফিরে গেলেন ফ্লেমিং।

পরদিন ল্যাবরেটরিতে ঢুকেই টেবিলের একপাশে সরিয়ে রাখা প্লেটটির দিকে নজর পড়ল। ভাবলেন, প্লেটটি ধুয়ে কাজ শুরু করবেন। কিন্তু প্লেটটি তুলে ধরতেই চমকে উঠলেন। গতকাল প্লেট ভর্তি ছিল যে জীবাণু দিয়ে, সেগুলো আর নেই। ভালো করে পরীক্ষা করতেই দেখলেন সব জীবাণুগুলো মারা গিয়েছে। চমকে উঠলেন ফ্লেমিং। কিসের শক্তিতে নষ্ট হলো এতগুলো জীবাণু? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে পড়লো গতকাল খানিকটা সর্দি পড়েছিল প্লেটের উপর। তবে কি সর্দির মধ্যে এমন কোন উপাদান আছে যা এই জীবাণুগুলোকে ধ্বংস করতে পারে? পরপর কয়েকটি জীবাণু কালচার করা প্লেট টেনে নিয়ে তার উপর নাক ঝাড়লেন। দেখা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই জীবাণুগুলো নষ্ট হতে আরম্ভ করেছে। এই আবিষ্কারের উত্তেজনায় নানাভাবে পরীক্ষা শুরু করলেন ফ্লেমিং। দেখা গেল- চোখের পানি, থুথুর জীবাণু ধ্বংস করার ক্ষমতা আছে। আর দেহ নির্গত এই প্রতিষেধক উপাদানটির নাম দিলেন লাইসোজাইম, যার অর্থ জীবাণু ধ্বংস করা। সাধারণ জীবাণুগুলোকে এটি ধ্বংস করলেও অধিকতর শক্তিশালী জীবাণুগুলোর ক্ষেত্রে ব্যার্থ হয়। তারপর আট বছর কেটে গেল।

একদিন লক্ষ্য করলেন, আকস্মিকভাবেই ঝড়ো বাতাসে খোলা জানালা দিয়ে ল্যাবরেটরির বাগান থেকে কিছু ঘাস পাতা উড়ে এসে পড়ল জীবাণু ভর্তি প্লেটের উপর। খানিক পরে প্লেটগুলো টেনে নিতেই দেখলেন জীবাণুর কালচারের মধ্যে স্পষ্ট পরিবর্তন। মনে হলো, নিশ্চয়ই এই আগাছাগুলোর মধ্যে এমন কিছু আছে যার জন্যে পরিবর্তন ঘটল। ভালো করে পরীক্ষা করতেই লক্ষ্য করলেন আগাছাগুলোর উপর ছত্রাক জন্ম নিয়েছে। সেই ছত্রাকগুলো বেছে নিয়ে জীবাণুর উপর দিতেই জীবাণুগুলো ধ্বংস হয়ে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, তার এতোদিনের সাধনা অবশেষে সিদ্ধি লাভ করলো। এই ছত্রাকগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম ছিল পেনিসিলিয়াম নোটেটাম। তাই এর নাম দিলেন পেনিসিলিন। রসায়ন সম্মন্ধে জ্ঞান না থাকার কারণে পেনিসিলিন আবিষ্কার করলেও কীভাবে তাকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে ঔষধ হিসেবে প্রস্তুত করা যায় তার কোন ধারণা ফ্লেমিং করে উঠতে পারেন নি।

আলেকজান্ডার ফ্লেমিং সর্বপ্রথম পেনিসিলিন আবিষ্কার করলেও একে মানবদেহে ব্যবহারের উপযোগী অবস্থানে নিয়ে আসেন দু’জন বিজ্ঞানী- হাওয়ার্ড ফ্লোরি (১৮৯৮-১৯৬৮) ও আর্নস্ট চেইন (১৯০৬-১৯৭৯)। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই পেনিসিলিনের উপযোগিতা তীব্রভাবে সকলে অনুভব করল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাওয়ার্ড ফ্লোরির নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী কীভাবে পেনিসিলিনকে ঔষধে রূপান্তরিত করা যায় তা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করলেন। ফ্লোরির সাথে ছিলেন রসায়নবিদ ড. চেইন। কয়েক মাস প্রচেষ্টার পর তারা সামান্য পরিমাণ পেনিসিলিন তৈরি করতে সক্ষম হলেন। প্রথমে তারা কিছু জীব জন্তুর উপর পরীক্ষা করে আশাতীত ভালো ফল পেলেন। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল মানুষের উপর পরীক্ষা। আকস্মিকভাবে সে সুযোগও এসে গেল।

একজন পুলিশ কর্মচারী মুখে সামান্য আঘাত পেয়েছিলেন। তাতে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল তা দূষিত হয়ে জীবাণু রক্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। ডাক্তাররা তার জীবনের সব আশা ত্যাগ করেছিল। ১৯৪১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী প্রফেসর ফ্লোরি স্থির করলেন এই মুত্যু পথযাত্রী মানুষটির উপরই পরীক্ষা করবেন পেনিসিলিন। তাকে তিন ঘন্টা অন্তর চার বার পেনিসিলিন দেয়া হল। ২৪ ঘন্টা পর দেখা গেল যার আরোগ্য লাভের কোন আশাই ছিল না, সে প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে। এই ঘটনায় সকলেই উপলব্ধি করতে পারলো চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কি যুগান্তকারী প্রভাব বিস্তার করতে চলেছে পেনিসিলিন। ডা: চেইন বিশেষ পদ্ধতিতে পেনিসিলনকে পাউডারে পরিণত করলেন এবং ডাঃ ফ্লোরি তা বিভিন্ন রোগীর উপর প্রয়োগ করলেন। কিন্তু যুদ্ধে হাজার হাজার আহত মানুষের চিকিৎসায় ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত পেনিসিলিন প্রয়োজনের তুলনায় ছিল নিতান্তই কম।

আমেরিকার Northern Regional Research ল্যাবরেটরি এ ব্যাপারে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। মানব কল্যাণে নিজের এ আবিষ্কারের ব্যাপক প্রয়োগ দেখে আনন্দে অভিভূত হয়ে উঠেছিলেন ফ্লেমিং। মানুষের কোলাহলের চেয়ে প্রকৃতির নি:সঙ্গতাই তাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করত। মাঝে মাঝে প্রিয়তমা পত্নী সারিনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। সারিন শুধু যে তার স্ত্রী ছিলেন তা-ই নয়, ছিলেন তার যোগ্য সঙ্গিনী। ১৯৪৩ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৪৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজ দরবারের তরফ থেকে তাকে নাইট উপাধি দেয়া হল। ১৯৪৫ সালে তিনি আমেরিকা গেলেন। ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে তিনি ফরাসি সরকারের আমন্ত্রণে ফ্রান্সে গেলেন। সর্বত্র পেলেন তিনি বিপুল সংবর্ধনা। প্যারিসে থাকাকালীন সময় তিনি জানতে পারলেন এ বছরের মানব কল্যাণে পেনিসিলিন আবিষ্কার এবং স্বার্থক প্রয়োগের জন্য নোবেল প্রাইজ কমিটি চিকিৎসা বিদ্যায় ফ্লেমিং, ফ্লোরি ও ডা: চেইনকে একই সাথে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করেছে। এ পুরষ্কার পাওয়ার পর ফ্লেমিং কৌতুক করে বলেছিলেন, ‘এ পুরষ্কারটি ঈশ্বরের পাওয়া উচিত, কারণ তিনিই সবকিছুর আকস্মিক যোগাযোগ ঘটিয়েছেন’।

ফ্রান্স থেকে ফিরে এসে তিনি আবার সেন্ট মেরি হাসপাতালে ব্যাক্টেরিয়োলজির গবেষণায় মনোযোগী হয়ে উঠেন। ৪ বছর পর তার স্ত্রী সারিন মারা যান। এ মৃত্যুতে মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন ফ্লেমিং। তার জীবনের এই বেদনার্ত মুহুর্তে পাশে এসে দাঁড়ালেন গ্রীক তরুণী আমালিয়া তারুকা। আমালিয়া ফ্লেমিং এর সাথে ব্যাক্টেরিয়োলজি নিয়ে গবেষণা করতেন। ১৯৫৩ সালে দু’জনে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হলেন। কিন্তু এই সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হল না। ২ বছর পর ১৯৫৫ সালের ১১ মার্চ ৭৩ বছর বয়সে লন্ডনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ফ্লেমিং।

মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হল এই পেনিসিলিন আবিষ্কার। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন।

– নাহিদ মুনতাসির

ইবনে সিনাঃ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক

নাহিদ মুনতাসির (এস.এস.এম.সি)
বুখারার ‘আফসানা’র কাছাকাছি জন্মগ্রহণ করে যে অসাধারণ প্রতিভাধর ব্যক্তি তাঁর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছেন বাকিটা পৃথিবী তিনি ‘ইবনে সিনা’। তার পুরো নাম আবু আলী আল হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা। দশম শতাব্দীর অসামান্য এ মেধাবী ব্যক্তিত্ব ইউরোপে আভিসিনা (আরপবহহধ) নামে সাধারণভাবে পরিচিত।
৯৮০ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণকারী ইবনে সিনার অবদান চিকিৎসা শাস্ত্রে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রায় ৭০০ বছর ধরে তাঁর লিখিত বইগুলো অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ সহ ইউরোপের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হতো।
ইবনে সিনা তাঁর প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন বুখারায়। ইসমাইল সুফী, আবু আব্দুল্লাহ নাতিলিসহ অন্যান্য বিখ্যাত শিক্ষকের কাছে দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি, ফিকহ, তাফসীর ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। এমন বহু দিন রাত্রি অতিবাহিত হয়েছে যার মধ্যে তিনি ক্ষণিকের জন্যও ঘুমাননি। কেবলমাত্র জ্ঞানসাধনার প্রতিই ছিল তার মনোনিবেশ। যখনি কোন সমস্যার সম্মুখীন হতেন তিনি তখনই মসজিদে গিয়ে সিজদায় পড়ে কান্নাকাটি করে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার জ্ঞানের দরজাকে খুলে দাও। জ্ঞান লাভ ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কোন কামনা নেই।’
সে সময় বুখারার স¤্রাট ছিলেন নূহ ইবনে মনসুর। স¤্রাটের এক দূরারোগ্য ব্যধির চিকিৎসা করতে দেশ-বিদেশের বড় বড় চিকিৎসকেরা ব্যর্থ হবার পর এগিয়ে আসেন তরুণ ইবনে সিনা। তাঁর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন স¤্রাট। কৃতজ্ঞ স¤্রাট তাঁকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। কিন্তু ইবনে সিনা রাজি হলেন না। তার বদলে চাইলেন রাজকীয় গ্রন্থাগার ব্যবহারের সুযোগ। এই গ্রন্থাগারের সব গ্রন্থ ইবনে সিনা কয়েক দিনের মধ্যেই আত্মস্থ করে ফেলেন।
ইবনে সিনা চিকিসাশাস্ত্রের উপর প্রচুর লেখালেখি করেছেন। ঈধহহড়হ ড়ভ গবফরপরহব (অষ কধহঁহ ঋর অষ ঞরনন) এবং ঞযব ইড়ড়শ ড়ভ ঈঁৎব (করঃধন অষ ঝযরভধ) এ দুটি অবিস্মরণীয় বইয়ের লেখক তিনি। ইবনে সিনা তার বইগুলোতে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার বর্ণনাও দিয়েছেন। যেমনঃ সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড দ্রবণ, ক্যালসিয়াম পলি সালফাইড, কপার ও সোনার ভষ্মীকরণ, সালফারের তরলীকরণ ইত্যাদি।
অসাধারণ মেধাবী ইবনে সিনা ‘জড়তা’ ধারণার প্রবক্তা। তিনি ‘কিতাব আন নাজাত’ বইতে লিখেছিলেন, ‘কেউ নিজে নিজে নড়াচড়া বা নিজে নিজে স্থির হতে পারে না;’ যা জড়তার মূলনীতির একটি স্পষ্টতর ব্যাখ্যা। এছাড়া ইবনে সিনা ঝঢ়বপরভরপ এৎধারঃু নিয়েও গবেষণা চালান।
জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতের সময়েও ইবনে সিনা কখনোই জ্ঞানের চর্চা থামিয়ে রাখেন নি। একে একে তিনি খোয়ারিজম, গুরুগঞ্জ, খোরাসান প্রভৃতি শহর ভ্রমণ করেন। এ সময় গজনীর সুলতান মাহমুদ তাঁকে তাঁর রাজ্যসভায় যোগ দিতে আদেশ করেন। কিন্তু ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হবে এই ভয়ে তিনি তাঁর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে ‘জর্জন’ নামক স্থানে আত্মগোপন করেন। সুলতান মাহমুদ সেখানেও তাঁকে খুঁজতে লোক পাঠালে তিনি ইরানের দিকে রওনা হন। পথিমধ্যে তিনি কবি ফেরদৌসির জন্মস্থান ‘তুস’ নগরী পরিদর্শন করেন এবং পরবর্তীতে ইরানের সুপ্রাচীন শহর হামদানে গমণ করেন। ঘটনা পরিক্রমায় ইবনে সিনা হামদান থেকে পলায়ন করে ইস্পাহানে আসেন। এখানেই তিনি ‘কিতাব আল ইশারাত’ রচনা করেন।
পরবর্তীতে হামদান ও ইস্পাহানের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেলে ইবনে সিনা সৈন্যবাহিনীর সাথে যেতে বাধ্য হন। একদিন তাঁর ভৃত্য ষড়যন্ত্র করে ওষুধের সাথে আফিম মিশিয়ে দিলে বিষক্রিয়ায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে। মুসলিম চিকিৎসাশাস্ত্র ও দর্শনের এ অনন্য চিন্তানায়ক মৃত্যুবরণ করেন ১০৩৭ খৃস্টাব্দে।
যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের অস্তিত্ব ছিল না, তখন হিপোক্রেটস তা সৃষ্টি করেন, যখন তা মরে গিয়েছিল তখন তা পুনরুজ্জীবিত করেন ‘গ্যালেন’, যখন তা বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, তখন ‘আল রাজী’ এ বিজ্ঞানকে সুসংবদ্ধ করেন আর ‘ইবনে সিনা’ একে পরিপূর্ণতা দান করেন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার সৃষ্টির মাধ্যমে।