দিবস পর্যালোচনা: বিশ্ব এইডস্ দিবস

aids

বর্তমান বিশ্বে এইডস্‌কে চিহ্নিত করা হয়েছে এক নম্বর মহামারী বা প্যান্ডেমিক হিসেবে। এখন পর্যন্ত এইচআইভিকে প্রতিরোধ করার জন্য কোন টিকা বা এটি সারানোর মত কোন চিকিৎসা বের হয়নি। পরীক্ষামূলকভাবে টিকা তৈরীর প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এর প্রতিরোধের কোন টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এর একটাই রক্ষাকবচ, আর তা হল জনসচেতনতা। আর এ জনসচেতনতা বৃদ্ধির একটি চেষ্টা হিসেবে প্রতিবছর ১ ডিসেম্বর ‘বিশ্ব এইডস্ দিবস’ হিসেবে পালিত হয় বিশ্বব্যাপী।

সর্বপ্রথম ১৯৮৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মেলনে এইডস্ দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন জেমস ডব্লিউ বান ওটমাস নেটার। ইউএনএআইডিএস এর মহাপরিচালক জোনাথন ম্যান এ প্রস্তাবটি সমর্থন করেন এবং ১৯৮৮ সাল থেকে ১ ডিসেম্বরকে ‘বিশ্ব এইডস্ দিবস’ পালন করার ঘোষণা দেন। সেই থেকে প্রতিবছর এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে ‘বিশ্ব এইডস্ দিবস’ হিসেবে। প্রতি বছরের মত এবারো ১ ডিসেম্বর রবিবার, সারাবিশ্বে পালিত হয়েছে ‘বিশ্ব এইডস্ দিবস’। এ মহামারী সংকট নিরসনকল্পে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মানসে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এ দিনটিতে বিভিন্ন কর্মসূচী পরিচালনা করে।

১৭তম বারের মত পালিত এ দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ছিল “শূন্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জন”। এ প্রতিপাদ্যের উদ্দেশ্য হলো ২০১৫ সালের মধ্যে এইচআইভির নতুন সংক্রমণ ও এইচআইভি আক্রান্তদের প্রতি বৈষম্যরোধ ও এইডস্ আক্রান্তদের মৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। অদূর ভবিষ্যতে এইডস্ মুক্ত প্রজন্ম গড়ে তোলাই দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের হিসাব মতে পুরো বিশ্বে মোট এইচআইভি আক্রান্তদের সংখ্যা ছিল ৩৫.৩ মিলিয়ন। দক্ষিন আফ্রিকার কেপটাউনে ৭ হতে ১১ ডিসেম্বর জুড়ে ICASA উদ্যোগে এইডস্ মুক্ত আফ্রিকা গড়ে তোলার টার্গেটকে সামনে রেখে এইডস্ ও যৌনরোগ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। দেশ বিদেশের প্রায় দশ হাজার বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, নীতি নির্ধারক, সরকারি কর্মকর্তা আর সক্রিয় কর্মীদের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহনে অনুষ্ঠিত এ কনফারেন্সের সভাপতি ছিলেন SAA (Society for AIDS in Africa) এর প্রেসিডেন্ট, প্রফেসর রবার্ট সাউদ্রে এবং সহসভাপতি ছিলেন রাইট কেয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রফেসর ইয়ান সেম। এ কনফারেন্সে কিছু কর্মনীতি নির্ধারিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:-

১। আফ্রিকাসহ সারা বিশ্ব হতে এইডস বিষয়ক তথ্য ও পরীক্ষা পদ্ধতি আহরণ ও বিনিময়ের জন্য ফোরাম তৈরী
২। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্জন করার অভিপ্রায় আনয়ন
৩। অঙ্গীকারাবদ্ধ সকল কর্মী ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মীদের সেবার মানোন্নয়নের জন্য প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা

ক্রোয়েশিয়াতে জাতিসংঘ, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় ও জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সমন্বিত উদ্যোগে জাতীয় পর্যায়ে কর্মসূচী ঘোষণা করা হয় এই দিনটিতে। এতে জনগণকে এইচআইভি পরীক্ষা করার জন্য আহবান জানানো হয়। বিখ্যাত ক্রোয়েশিয়ান ব্যান্ড টিবিএফ তাদের জনপ্রিয় গান “Positive Attitude’’ এই দিনটির জন্য উৎসর্গ করে। জাপানের নাগোয়া SCORA সংগঠনটি এইডস্ দিবস উপলক্ষ্যে বিরাট প্যারেডের আয়োজন করে।

পিছিয়ে ছিল না বাংলাদেশও। ১ ডিসেম্বর রবিবার এদেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ, বিশেষ করে তরুণদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে দেশব্যাপী ও বিভিন্ন স্থানে দিনব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠান, সভা ও কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে দিনটি উদযাপিত হয়। জাতীয় এইডস্ ও এসটিডি প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও কতিপয় এনজিও গ্রুপ কর্তৃক যৌথভাবে আয়োজিত একটি র্যা লি মানিক মিয়া এভিনিউ হতে বের করা হয়। অতঃপর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

দিনটির উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথি স্বাস্থ্যমন্ত্রী রওশন এরশাদ এইচআইভি সংক্রমনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর আরোপ করে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকদের এইডস্ ও এইচআইভি সম্পর্কে ধারণা নেই; বিশেষ করে বিবাহিত মহিলা ও তরুণ প্রজন্মকে এ বিষয়ে প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। এখানেও প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল জাতিসংঘ নির্ধারিত শ্লোগান ‘HIV সংক্রমণ ও AIDS এ মৃত্যু একটিও নয়’ আর ‘বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়বো সবাই, এ আমাদের অংগীকার’। PIHIV এর প্রেসিডেন্ট হাবিবা আক্তার বলেন যে, প্রচলিত সমাজভিত্তিক ত্রুটিপূর্ণ ধারণা মুছে দিতে দেশজুড়ে জোর প্রচেষ্টা চালানো উচিত। এছাড়াও উক্ত অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন- হেলথ সার্ভিসের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: খন্দকার এম সিফায়েত উল্লাহ, UNAIDS এর সমন্বয়ক ডা: লিও কেনি, WHO এর প্রতিনিধি টুশারা ফার্নান্ডো, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা: ইকবাল আর্সলান প্রমুখ।

তারা সবাই একটি বিষয়ে একমত হন যে, এইডসের ভয়াবহতা দূরীকরণে ব্যাপক গণসচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ, ধর্মীয় নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার কোন বিকল্প নেই। রাজধানীর অন্যান্য স্থানেও সমাজকর্মীগণ র্যা লি বের করেন। স্বাস্থ্যসচিব এম এম নেয়াজ উদ্দীন বলেছেন যে, এ বছর (২০১৩) এদেশে ৩৭০ জন নতুন এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তি সনাক্ত করা হয়েছে। তন্মধ্যে এইডস্ আক্রান্ত হয়েছে ১৯৫ জন, মারা গিয়েছে ৮২ জন। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম এদেশে এইচআইভি শনাক্ত করা হয়। এরপর থেকে এ যাবতকালে সর্বমোট লিপিভুক্ত এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা ৩২৪১, এইডস্ রোগী মোট ১২৯৯ এবং মারা গিয়েছে ৪৭২ জন।

রাজধানীর বাইরে অন্যান্য শহরেও দিনটি পালিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কুমিল্লা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ আয়োজিত ৩ শতাধিক এনজিও কর্মী ও চিকিৎসকদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত কর্মশালা, দিনাজপুরের বিরামপুরে এনজিও ওয়ার্ল্ড কনসার্ন বাংলাদেশ এর উদ্যোগে পালিত মেহেরপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের আহবানে আয়োজিত আলোচনা সভা ইত্যাদি।

ডিসেম্বরের উল্লেখ্যযোগ্য অন্যান্য স্বাস্থ্য দিবসগুলোর মধ্যে ছিল আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস (৩ ডিসেম্বর) ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস (১০ ডিসেম্বর)। তাছাড়া ডিসেম্বর মাসটিকে এইডস্ সচেতনতার মাস ও কোষ্ঠকাঠিন্যের মাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জানুয়ারী মাসে ছিল বিশ্ব ব্রেইল (অন্ধদের লেখার প্রণালী) দিবস (৪ জানুয়ারী) এবং বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস (২৬ জানুয়ারী)।