চিকিৎসক-মিডিয়া সংঘাত সমাধান কোথায়?

head news 2চিকিৎসা ও সাংবাদিকতা। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সেবামূলক দুটি পেশা। সমাজের পীড়িত, অসহায় মানুষের অসুস্থতার কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেন চিকিৎসক। পাশাপাশি একজন সাংবাদিক জীবনের ভয় না করে সমাজের অসংগতিগুলো জনসম্মুখে তুলে আনেন; চেষ্টা করেন তা অপনোদনের। দীর্ঘ একটি সময় ধরেই এই দুই পেশার মানুষের মধ্যে চলছে এক অদৃশ্য বৈরিতা। কেন তৈরী হচ্ছে এই অনাকাক্সিক্ষত দূরত্ব? সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত বেশ কিছু ঘটনা অবলম্বনে এর স্বরূপ উদঘাটন করার চেষ্টা করেছে মেডি ভয়েস।
কেস স্টাডি- ১ ৬ মে ২০১৪। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্মব্যস্ত দুপুর। চিকিৎসাপ্রার্থী হাজার মানুষের কোলাহলে গমগম করছে হাসপাতাল প্রাঙ্গন। এর মধ্যেই ডাক্তারদের ওঠানামার জন্য নির্দিষ্ট লিফটে ওঠেন একজন দর্শনার্থী। ভীড় থাকার কারণে একজন চিকিৎসক তাকে বের হতে বলেন। ঘটনাটি এমনিতেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু সে ব্যক্তি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নেতা হওয়ার কারণে পরিস্থিতি অনেক দূর গড়ায়। সেসময় সংঘটিত হাতাহাতির জের ধরে কয়েক দফা ভাঙচুর হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগ। এর পরদিন চানখারপুল মোড়ে রাতের খাবার খেতে যাওয়ার সময় হামলা করা হয় একজন অনারারী মেডিকেল অফিসারের উপর। তিনি এতে দারুণভাবে আহত হন। এ ঘটনাতে মিডিয়া নিরপেক্ষতা দেখাতে পারেনি। তারা ধারাবাহিকভাবে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে থাকেন। রোগীর স্বজনকে ‘তোর মাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবো’ শীর্ষক মন্তব্য করেছেন একজন চিকিৎসক- এমন মিথ্যাচারও করেছে বাংলানিউজের মতো বহুল পঠিত অনলাইন পত্রিকা।
কেস স্টাডি- ২ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ২০ এপ্রিল। রাত ৯ টা। হিস্টিরিয়া (এইচ.সি.আর) রোগ নিয়ে ভর্তি হন আকাশ। কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার এক পর্যায়ে রোগীর প্রতি অসদাচরণের অভিযোগ আনেন তার ভাই। স্থানীয় হবার সুবাদে তার হম্বিতম্বিতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ঘটনা হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছায়। অন্য ওয়ার্ডের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা সেখানে জড়ো হন। পুলিশও পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে পরোক্ষ ইন্ধন যোগায়। ফলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এসময় অকুস্থলে সাংবাদিকরা এসে ঘটনা ভালো করে না জেনেই মিডিয়াতে খবর পৌঁছে দেন ‘চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু’। অর্থাৎ কোন মৃত্যু সংঘটিত হওয়ার আগেই জাতীয় ইলেকট্রনিক মাধ্যমগুলোতে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে স্ক্রলিং হতে থাকে চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর মতো স্পর্শকাতর খবর। ফলশ্র“তিতে চার দফা দাবিতে কর্মবিরতিতে যান চিকিৎসকরা।

headline1
কেস স্টাডি- ৩
গত ৯ এপ্রিল সিরাজুল ইসলাম নামের এক রোগী এড্রেনাল ক্রাইসিস নিয়ে ভর্তি হন ঢাকার বারডেম হাসপাতালে। ১৩ এপ্রিল তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর রোগীর স্বজনরা ৫০-৬০ জন দুষ্কৃতিকারী নিয়ে চিকিৎসকদের জিম্মি করে এবং হাসপাতালে ভাঙচুর চালায়। তারা কয়েকজন নারী চিকিৎসককেও লাঞ্ছিত করে। এর প্রতিবাদে ১৬ এপ্রিল কর্মবিরতি পালন করেন চিকিৎসকবৃন্দ। এই পুরো সময়টাতেই চিকিৎসকদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করে মিডিয়া।
কেস স্টাডি- ৪
সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ১৯ জুলাই ২০১২ সালে। জনৈক আরিফুল হক চৌধুরী সড়ক দূর্ঘটনায় আহত হয়ে হিমোপেরিটোনিয়াম নিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দীর্ঘ ১৪ দিন চিকিৎসকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠেন। ১৫ তম দিনে দায়িত্বরত একজন ইন্টার্নী চিকিৎসক তার ক্ষতস্থান ড্রেসিং করতে গেলে তিনি সেই চিকিৎসকের সাথে দুর্ব্যবহার করেন এবং অহংকারবশত তাঁকে কিছু কটুবাক্য শোনান। সেই চিকিৎসক নিজে কিছু না বলে বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি অবহিত করেন। তৎকালীন সার্জারী বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক ডা. শহীদ হোসেন। তিনি রোগীকে চিকিৎসকের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন, না হয় তাকে ছাড়পত্র দিয়ে দেয়ার হুমকি দেন। আরিফুল হক নতি স্বীকার না করে হাসপাতালে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। ঘটনার ঘন্টা দুয়েক পর বিনা অনুমতিতে সাংবাদিকেরা ওয়ার্ডে প্রবেশ করে চিকিৎসকদের জেরা করতে শুরু করেন। পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একাধিক বার চিকিৎসক সাংবাদিক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষ, মিছিল সংঘটিত হয়। চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে ডাকা হয় কর্মবিরতি। সাংবাদিকরাও কয়েক দফা মিছিল করেন। এসময় তারা হাসপাতালের পরিচালকসহ শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে দুটি মামলাও দায়ের করেন। পরবর্তীতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও হাসপাতালের সদর দরজায় সেঁটে দেয়া হয় বিনা অনুমতিতে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার নোটিশ ।
কেস স্টাডি- ৫
তারিখ ৫ অক্টোবর ২০১৩। টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের বিশেষায়িত নবজাতক সেবাকেন্দ্রে একই দিনে মৃত্যুবরণ করে চারটি শিশু। মুমূর্ষু অবস্থায় ভর্তি হওয়া এই শিশুগুলোর মৃত্যু কতটা স্বাভাবিক তা ডাক্তার মাত্রই জানেন। কিন্তু এই ঘটনায় জাতীয় প্রচার মাধ্যমে দারুণ নেতিবাচক প্রচারণা করা হয়। বলা হয়, কর্তব্যরত চিকিৎসকের ভুল প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ইনজেকশন দেয়ায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে সারাদিন ফলাও করে প্রচার করা হয় এই খবর। কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সাইফুল ইসলামকে দায়ী করা হয় কোন তদন্ত ছাড়াই। অথচ পরবর্তীতে তদন্তে দেখা যায়, এখানে চিকিৎসকের কোন ভুলই ছিল না। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় কাছাকাছি সময়ে মৃত্যুবরণ করে শিশুরা।
মেডিকেল সাংবাদিকগণ তাদের লেখনির মাধ্যমে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অসংগতি, পদস্খলনগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করবেন। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতের অর্জনগুলো জনসম্মুখে তুলে ধরে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখবেন। যেহেতু সংবাদগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের প্রতিনিধিত্ব করে, উচ্চমহলকে এই খাত সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ করতে সহায়তা করে সেহেতু ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ প্রতিফলনই সবার প্রত্যাশা। দূর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশের চিকিৎসা-সাংবাদিকবৃন্দ এই অপার সম্ভাবনাকে কাজে না লাগিয়ে স্বেচ্ছাচারিত্বমূলক আচরণ করছেন। এর ফলে এমন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে বার বার। ফলে কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। দূর্ভোগ বাড়ছে রোগীদের। দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা কার্যক্রম। পাশাপাশি সাংবাদিক-চিকিৎসকের সাপে-নেউলে সম্পর্কের কারণে অনেক ভালো অর্জনই প্রচার পাচ্ছে না গণমাধ্যমে। একই সাথে এই বিরোধকে পুঁজি করে সত্যিকারের কিছু দূর্নীতিবাজ মানুষ নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। এই অচলাবস্থায় সরকারের দায়িত্বশীল মহলের কপালে দেখা দিয়েছে চিন্তার ভাঁজ।
এ সংঘাতের পেছনের সম্ভাব্য কারণঃ
– অপরাধ সাংবাদিকতা করেন এমন সাংবাদিকদের একটি অংশ মেডিকেল সাংবাদিকতা করে থাকেন। এক্ষেত্রে কোন আলাদা যোগ্যতার শর্ত দেয়া নেই সাংবাদিকতার নীতিমালায়। নেই প্রশিক্ষণের আলাদা কোন সুযোগ। ফলে তারা স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত টার্মিনোলজি সম্পর্কে যথাযথভাবে ওয়াকিবহাল নন। তাই অনিচ্ছাতেও তাদের ভুল হয়ে যেতে পারে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে মাঝে মাঝেই সাংবাদিকদের নানামুখী প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়ে থাকে তবুও বাস্তবতার তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। সাম্প্রতিক সময়ে দৈনিক কালের কণ্ঠে একটি রিপোর্টে দাবি করা হয় যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুপুরের পর কোন রেজিস্টার্ড ডাক্তার থাকেন না! এমনকি তারা দাবি করেন অনারারী মেডিকেল অফিসাররা নাকি এমবিবিএস সার্টিফিকেট প্রাপ্ত রেজিস্টার্ড ডাক্তার নন!
– ‘a bad news is a good news.’ সাংবাদিকতার অন্যতম মূলনীতি। তাই চিকিৎসা খাতে অর্জনের খবরগুলোর চেয়ে অবহেলার খবরগুলোর প্রচার করে পত্রিকার কাটতি বাড়াতে সংবাদ মাধ্যমের আগ্রহ থাকে বেশি।
– সিন্ডিকেটেড সাংবাদিকতা বর্তমানে একটি পরিচিত শব্দ। পেশাগত দায়িত্ব পালনের চেয়ে সহকর্মীর স্বার্থ হাসিলে অনেকক্ষেত্রেই নৈতিকতাবোধের জলাঞ্জলি দেন সাংবাদিকবৃন্দ।
– বর্তমানে যেহেতু অধিকাংশ মিডিয়াগুলো কোন না কোন ব্যক্তির ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অধীন, সেহেতু সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি জনগনের আস্থা নষ্ট হলে তারা বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবার দিকে ঝুঁকবে- এই আকাক্সক্ষার বাস্তবায়নেও যদি অপপ্রচার চলে তবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
– নানামুখী অবৈধ সুবিধা আদায়ের জন্য কিছু সংবাদ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত ঘটনা ভুলভাবে উপস্থাপন করে। সংবাদপত্রের কর্তাব্যক্তিদের অর্থলোভী আচরণের শিকার হয় স্বাস্থ্যখাত। নেতিবাচক রিপোর্ট করতে বাধ্য হন অধীনস্থ রিপোর্টাররা।
– চিকিৎসকেরা স্বভাবতই দেশপ্রেমের চেতনা ধারণ করেন। কিন্তু কিছু বিবেকবর্জিত চিকিৎসক সত্যি নানা দূর্নীতি, অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে পকেট ভারী করার চেষ্টা করেন। এই অন্যায়গুলোকে সাধারণভাবে সবার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ায় সামগ্রিকভাবে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। ফলাফলে এই সুযোগে পার পেয়ে যায় আসল অপরাধী।
এই অচল অবস্থার দ্রুত নিরসন জরুরী। কী হতে পারে সেই সমাধানের কাক্সিক্ষত রূপরেখা?
এ সম্পর্কে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে ডাক্তার, রোগী, কর্মকর্তা, কর্মচারী, প্রশাসন, মিডিয়াসহ সবার নেতিবাচক আচরণের শিকার হচ্ছে সরকারি হাসপাতালগুলো। এক্ষেত্রে সামষ্টিক অসচেতনতা অনেকাংশেই দায়ী। সবার ইতিবাচক উদ্যোগের মাধ্যমে হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে সমাজের মানুষকে। তবে সরকারের উচিত এ ব্যাপারে আরো কার্যকরী ভূমিকা পালন করা।’
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘রোগী ও চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় আইন করতে হবে, কিছু হলেই যাতে ডাক্তারদের মারধর বা হাসপাতাল ভাঙচুরের সাহস কেউ করতে না পারে তেমনি ডাক্তাররাও ধর্মঘটের নামে রোগীদের জিম্মি করতে না পারে। সাংবাদিকদেরও উচিত সংবাদ প্রকাশে বস্তুনিষ্ঠ ও সংযমী আচরণ করা।’
প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও প্রবীণ চিকিৎসক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী চিকিৎসক ও রোগীদের সম্পর্কের অবনতির বিষয়ে বলেন, ‘ডাক্তারদের উপর মানুষের আস্থা বিশ্বাস অনেক বেশি। তাই অল্প বিচ্যুতি দেখলেই রোগী বা তাদের স্বজনদের মধ্যে ডাক্তারদের সম্পর্কে ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা কাটানোর দায়িত্ব ডাক্তারদের আছে অবশ্যই। কিন্তু মিডিয়াতে অযথা তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক খবর প্রচার করে এই বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরী করাটা কোনভাবেই কাম্য নয়।’
অন্যান্য খাতের মতো বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতও দুর্নীতিমুক্ত নয়। চিকিৎসকদের সবাই ন্যায়-নীতির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন এমনটাও দাবি করার সুযোগ নেই। এই খাতে সংঘটিত দূর্নীতিগুলো নির্মোহ ও নির্ভীক উপস্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতের ক্রমশ উন্নয়নে সাংবাদিক বৃন্দ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
আরিফুল হকের সংশ্লিষ্ট ঘটনায় প্রথম দিনই হাসপাতালের পরিচালক ও কর্তাব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে ঘটনার প্রাথমিক সমঝোতার চেষ্টা করা হয়। সাংবাদিকদের অনুরোধ করা হয় উল্লেখিত ঘটনা সত্যতাটুকু জানিয়ে যাতে সবগুলো পত্রিকায় প্রেস রিলিজ দেয়া হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এর পরদিন কোন পত্রিকাতেই উক্ত প্রেস রিলিজটি ছাপানো হয় নি। তার চেয়ে বরং ডাক্তারদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেই পত্রিকাগুলো ছিল বেশি উন্মুখ। ফলাফলে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে চিকিৎসক সমাজ।
ডাক্তারদের অগণিত কঠোর পরিশ্রমে সুস্থ হওয়া হাজার হাজার রোগীর সুস্থতার খবর কখনো মিডিয়ার চোখে পড়েনা। কিন্তু হঠাৎ কোন দূর্ঘটনা হলেই ‘চিকিৎসকের অবহেলা’ অথবা ‘ভুল চিকিৎসা’ শীর্ষক খবরগুলো পত্রিকাতে ফলাও করে ছাপা হয়। কথা হলো একজন সাংবাদিক কি যোগ্যতা রাখেন ভুল চিকিৎসা কিংবা চিকিৎসায় অবহেলার পরিমাপ নির্ধারণের। যেখানে চিকিৎসকেরা দীর্ঘ একটি সময় ব্যয় করে চিকিৎসাপেশা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন এবং তার অর্জিত জ্ঞান অনুসারে চিকিৎসা প্রদানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন সেখানে একজন সাংবাদিক কিছু না জেনেই কিভাবে চিকিৎসার সত্যাসত্য নির্ধারণ করেন।
এ বিষয়ে রেডিও টুডের সিনিয়র সাংবাদিক জনাব সোহেল রানা বলেন, ‘আমাদের কাছে সংবাদের গুরুত্ব তার প্রভাবের উপর নির্ভর করে। একজন ডাক্তার ভালো কাজ করবেন, এটা স্বাভাবিক। এটি কখনো খবর হতে পারে না। খবর হবে তখনই যখন তার বিরুদ্ধে কোন দূর্নীতি কিংবা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ আসে। তবে এটিও সত্য যে, কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য সংবাদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। এটি একেবারেই অনৈতিক।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডীন ডা. এ.বি.এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভুল হতেই পারে। তদন্তে তা প্রমাণিত হলে চিকিৎসককে বিপুল অংকের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। এমনকি তার লাইসেন্সও বাতিল করা হতে পারে। যদিও ডাক্তারদের ভুল নির্ণয় করার যোগ্যতা রোগীর আত্মীয় স্বজন কিংবা সাংবাদিকদের নেই। তা করতে হবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমেই।’
সম্প্রতি রোগী সুরক্ষা আইন নামে একটি আইনের খসড়া হচ্ছে। এতে রোগীদের অধিকারের পাশাপাশি চিকিৎসকদের অধিকার সুনিশ্চিত করার আন্তরিক প্রয়াস পেয়েছে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও এমন নীতিমালা প্রণয়ন করা অতীব জরুরী। তাহলে অচিরেই কর্মক্ষেত্রে সাংবাদিক-চিকিৎসকদের অযথা বৈরিতার আশু অবসান ঘটবে। চিকিৎসার মতো মহান পেশাকে কালিমাযুক্ত না করে সত্যিকারের অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন হোক সাংবাদিকতার শপথ। শ্রদ্ধাবোধ ও সহমর্মিতার মেলবন্ধনে আমরা সবাই এগিয় যেতে চাই সামনে। তবেই না আমাদের হাত ধরে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। একসময় গড়ে উঠবে অহংকার করার মতো দূর্নীতিমুক্ত আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। এ অবস্থানে পৌঁছতে সব পেশার মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। হৃদয়ের গভীর থেকে প্রজ্জ্বলিত করতে হবে দেশপ্রেমের দ্বীপশিখা।
মেডিভয়েস ডেস্ক