‘‘রোগীই হচ্ছে তোমার সবচেয়ে জরুরি বিষয়’’- ‘মেডি ভয়েস’ এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে প্রফেসর ডাঃ কলিন রবার্টসন

222

মেডি ভয়েসঃ স্যার, বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগতম। কেমন লাগছে এই দেশ?
কলিন রবার্টসনঃ আমার খুব ভালো লেগেছে। তোমাদের দেশের মানুষ খুব আন্তরিক আর কৌতূহলী। এ ব্যাপারটা আমার ভালো লেগেছে।

মেডি ভয়েসঃ আপনার সাথে কথা বলার সুযোগ দেয়ায় আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কলিন রবার্টসনঃ ওকে, তোমাদের সাথে বসতে পেরে আমিও খুশি হয়েছি। তো, তোমরা কি বিষয়ে জানতে চাচ্ছো?

মেডি ভয়েসঃ স্যার, প্রথমেই জানতে চাচ্ছি, আপনি আজকের ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রোগ্রামটি কেমন উপভোগ করলেন?
কলিন রবার্টসনঃ আজকের? আচ্ছা, এটা বাংলাদেশে আমার প্রথম সফর। আমাকে বলতে হবে, এটা আমাকে বিস্মিত করেছে। আমি আশা করেছিলাম আমার লেকচারে ৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী থাকবে। কিন্তু সেখানে তো প্রায় ৫০০ জনের মতো ছিল। এটা আমাকে সত্যিই অনেক বেশি অভিভূত করেছে যে, ছাত্ররা ক্লাসের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী ছিল। এবং আমার দেয়া ক্লিনিকাল প্রব্লেমগুলো সমাধানে তাদের প্রবল আগ্রহ আমার ভালো লেগেছে। তারা ছিল অনেক বেশি ইন্টারেকটিভ।

মেডি ভয়েসঃ স্যার, এটা তো এখানে আপনার প্রথম সফর। আপনি আমাদের হাসপাতাল ঘুরে দেখেছেন। এখানকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
কলিন রবার্টসনঃ ওকে, ওকে। আমি দেখলাম (যদি ভুল হয়ে থাকে শুধু শুধরে দেবে দয়া করে) UK-র মত তোমাদের দেশেও একটি মোটামুটি বিনামূল্যের স্বাস্থ্যসেবা চালু আছে। অবশ্য বেশ কিছু প্রাইভেট হাসপাতালও আছে। যদিও অনেক প্রাইভেট হাসপাতাল বেশ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও প্রযুক্তি সমৃদ্ধ। তবুও তোমাদের দেশেও আমাদের দেশের মতো সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক ভালো চিকিৎসা দেয়া হয়। আমি আমার ব্যক্তিজীবনে সবসময় সরকারি হাসপাতালেই কাজ করেছি এবং কখনও প্রাইভেট হাসপাতালে কাজ করিনি। তাই সরকারি হাসপাতালের প্রতি আমার একটা ভালোলাগা আছে।

মেডি ভয়েসঃ স্যার, বাংলাদেশের বিখ্যাত ডাক্তারদের মধ্যে আপনার পূর্বপরিচিত কেউ কি আছেন?
কলিন রবার্টসনঃ অবশ্যই। তোমাদের ডীন, মেডিসিনের প্রফেসরবৃন্দ আমাদের নিকট খুব পরিচিত এবং তাদের অনেকেই ডেভিডসনস’ মেডিসিন বইয়ের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা ও কন্ট্রিবিউটর।

মেডি ভয়েসঃ স্যার, আপনি কি তাদের কয়েকজনের নাম বলবেন?
কলিন রবার্টসনঃ আমি মনে করি, তোমাদেরই উচিত নামগুলো বলা (হাসি)।

মেডি ভয়েসঃ স্যার, আমরা যতটুকু জেনেছি আপনি Macleod’s Clinical Examination বইটির প্রণোদনা প্রোগ্রামে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। এছাড়া আর কি কোন উদ্দেশ্য ছিল?
কলিন রবার্টসনঃ ওকে, আমি যেটা বুঝাতে চাচ্ছি, আমি আসলে প্রধানত বাংলাদেশে এসেছি তোমাদের সাথে মিশতে এবং তোমাদের শেখাতে। হ্যাঁ, আমি বই লিখি এবং হ্যাঁ, আমি ম্যাকলিওডস্ এর সিনিয়র এডিটর। কিন্তু সেটা এখানে আসার মূল কারণ নয়। আমি এখানে এসেছি মূলত তোমাদের মত ছাত্রদের সাথে মিশতে। বিশেষ করে তোমাদের সমস্যাগুলো শুনতে এবং তোমাদের কাছে শিখতে ও যতটুকু পারি তোমাদের শেখাতে। এটাই আসলে আমার বাংলাদেশে আসার কারণ।

মেডি ভয়েসঃ স্যার, আপনি লেখালেখিতে কিভাবে আসলেন?
কলিন রবার্টসনঃ ওকে, আমি প্রথমত একজন পুরোদস্তুর ক্লিনিশিয়ান এবং রোগী দেখতে এবং চিকিৎসা করতেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। একই সময়ে পড়াতেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আর লেখালেখিটা আমার চিন্তাকে পরিমার্জিত করে, সংক্ষিপ্ত করে। অনেক অনেক অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন ডাক্তার আছেন যারা খুব ভালো লিখেন না এবং সব ভালো লেখক ভালো চিকিৎসক না-ও হতে পারেন। আমি বোধহয় এই লেখালেখি করতে গিয়েই কিভাবে আরো ভালোভাবে রোগী দেখতে হয় এবং চিকিৎসা করতে হয় এই ব্যাপারগুলো বুঝতে শিখেছি। এই ব্যাপারটা আমার দারুণ লেগেছে। তাছাড়া নিজের অর্জিত জ্ঞান সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার দারুণ একটা আনন্দ আছে।

মেডি ভয়েসঃ স্যার, বাংলাদেশে মেডিকেল টেক্সট বই কিনতে অনেক খরচ করতে হয়, ফলশ্র“তিতে ছাত্রদেরকে পাইরেটেড কপি কিনতে বাধ্য হতে হয়….
কলিন রবার্টসনঃ এটি আসলে আমার ক্ষমতার বাইরে। দেখ, আমি একজন চিকিৎসকমাত্র। কিন্তু আমি যতটুকু জানি মাঝেমধ্যে পাইরেটেড কপিগুলোতে ভুলভ্রান্তি থেকে যায় এবং আমি নিশ্চিত যে, এখানকার প্রকাশকরা বইয়ের দাম কম রাখতে তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে। আমি বুঝাতে চাচ্ছি তোমাদের এখানকার বই এখনও UK-র চেয়ে অর্ধেক দামে পাওয়া যায়, যদিও তা-ও এখানে ভালোই ব্যয়বহুল। তবে সবচেয়ে আশার কথা- আমরা যেটা করেছি- Clinical Examination এর সকল ভিডিও ইউটিউবে সবার জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। অনেকেই হয়তো একটি ম্যাকলিওডস্ কেনার সামর্থ্য না-ও রাখতে পারে। কিন্তু খুব সহজেই ভিডিওগুলো দেখে নিতে পারে। UK-তে তো তা-ই হয়। তারা রোগীকে পরীক্ষা করতে গেলে কিংবা কোন পরীক্ষায় বসার আগে একবার হলেও ভিডিওগুলো দেখার চেষ্টা করে। এটা কিন্তু অনেক সহজলভ্য।

মেডি ভয়েসঃ স্যার, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের মতো আমাদের দেশেও স্বল্পমূল্যে বই সরবরাহ করা যায় কিনা?
কলিন রবার্টসনঃ দেখ, আমি, আগেই বলেছি, এ বিষয়টি আমার আয়ত্ত্বে নেই। তুমি প্রকাশকদের কাছে প্রশ্নটি করতে পার।

মেডি ভয়েসঃ ঠিক আছে স্যার। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি তো গত দু-তিনদিন ধরে বাংলাদেশ এবং ভারতে ছিলেন। তো, কেমন দেখলেন ছাত্রদের? আমাদের যদি কিছু মূল্যবান পরামর্শ দিতেন।
কলিন রবার্টসনঃ দেখো, তোমরা অল্পতেই দারুণ প্রভাব তৈরি করতে পার। এটা অবশ্যই তোমাদের একটা ভালো দিক। তবে তোমাদের ডাক্তার হওয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরো ওয়াকিবহাল হওয়া দরকার। যেমন ধরো, আমি অনেক মেডিকেল শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করেছি, কেন ডাক্তার হচ্ছো? জবাবে তারা বলেছে তারা মানুষের জীবন বাঁচাতে চায়। তখন আমি তাদের বলি, যাও, তাহলে পানি কিংবা পয়ঃনিষ্কাশন প্রকৌশলী হও। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করে এবং পয়ঃনিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে অনেক মানুষের জীবন তোমরা বাঁচাতে পারবে….। ডাক্তার হওয়ার উদ্দেশ্যতো শুধু এটা নয়। আবেগতাড়িত না হয়ে প্রফেশনাল হওয়ার চেষ্টা কর। অর্থ-সম্পদের কথা ভুলে যাও। খ্যাতির পেছনে ছুটো না। মনে রাখতে হবে, রোগীই হচ্ছে তোমার সবচেয়ে জরুরি বিষয়। সুতরাং রোগীর পরিচর্যায় তোমাকে লেখাপড়া অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে। যে ডাক্তার পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়, সে নিশ্চিত ভালো ডাক্তার হতে পারবে না। তোমাকে রোগীর কাছ থেকেও শিখতে হবে। শিখতে হবে ছাত্রদের কাছ থেকেও। যেমনটা আজকেও আমি শিখেছি।

মেডি ভয়েসঃ স্যার, ল্যাবটেস্টের আধিক্য সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
কলিন রবার্টসনঃ শোন, ল্যাবটেস্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে এটা শুধুমাত্রই একটি টেস্ট। ভালো করে রোগীর হিস্ট্রি নিলে এবং ক্লিনিকাল এগজামিনেশন করলে তখনই তোমার দেয়া টেস্টগুলো নৈতিক বৈধতা পাবে।

মেডি ভয়েসঃ স্যার, আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময় থেকে আমাদের সুযোগ দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার পরামর্শগুলো আমরা মেনে চলার চেষ্টা করব।
কলিন রবার্টসনঃ আমিও খুব খুশি হয়েছি তোমরা কষ্ট করে এসেছো বলে।

মেডি ভয়েসঃ স্যার, বাংলাদেশে আবারও আসার জন্য আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। ‘মেডি ভয়েস’ পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কলিন রবার্টসনঃ তোমাদেরকেও ধন্যবাদ।